ভাষার মান রাখতে নারীর অবদান
‘১৯৪৭-৪৮ সাল থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবেÑ এমন আলোচনা হতো আমাদের ৮২০০; পৈতৃক বাড়িতে। বাবা ছিলেন বেশ প্রগ্রেসিভ মাইন্ডের। বাবা তার বন্ধুদের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে নিজেদের মতামত একে অন্যদের জানাতেন। বেশির ভাগ সময়ে বাবার চিঠির খসড়া আমিই করতাম। এগুলো করতে করতে মনের অজান্তে কখন যে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকা আসার পর সরাসরি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি যার অনুপ্রেরণায় তিনি হলেন বামপন্থী সাংবাদিক লায়লা সামাদ। পুরানা পল্টনে আমাদের পাড়ায় থাকতেন তিনি। পিকেটিংয়েও নেতৃত্ব দিতেন লায়লা সামাদ।’ কথাগুলো বলেছেন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকা সুফিয়া আহমেদ।
আমরা মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলতে যতটুকু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তা অন্য কোনো ভাষায় সম্ভব নয়। আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাষা বাংলা, এ ভাষা আমাদের রক্তে কেনা। ভাষা আন্দোলনের সময় অগণিত ভাষাশহীদ রক্ত দিয়েছেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি মায়ের ভাষা বাংলা। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতার এক সারির মিছিলে ছিলেন আমাদের অনেক নারী। বাংলা ভাষার মান রাখতে তাদের অবদান আমাদের জাগিয়ে তোলে। সংগ্রামী প্রতিবাদী করে তোলে। ১৯৫২ সালের এই ফেব্রুয়ারি মাসেই মাতৃভাষার মর্যাদা রার প্রয়োজনে রক্ত দিয়েছিল বাংলার অসম সাহসী তরুণরা। পাকিস্তানি বুলেটও সে দিন তাদের দমাতে পারেনি। সে দিনের সেই আত্মদানই পরে রূপ নিয়েছিল বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে। পাকিস্তানি শাসকদের সব চক্রান্ত সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বাঙালি জাতি এগিয়ে গেল তার অভীষ্ট ল্েয। ৯ মাসের রক্তয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম হলো স্বাধীন বাংলাদেশের। তাই ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে আমাদের এত অহঙ্কার। এত গর্ব। সঙ্গত কারণেই ভাষার মাস নিয়ে আমাদের মধ্যে একটি অন্যরকম আবেগ কাজ করে। আবেগের পাশাপাশি ভাবতে হবে এই আবেগ যেনো ফেব্রুয়ারি মাসেই সীমাবদ্ধ না থাকে।
ভাষা আন্দোলনের সময় দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রী সুফিয়া আহমেদ। সেই সময় উইমেন্স হোস্টেল নামে একমাত্র ছাত্রী হোস্টেল ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র পরিষদের ডাক পড়লে ছাত্রছাত্রীরা এসে আমতলায় জড়ো হয়। তাদের সঙ্গে সুফিয়া আহমেদও ছিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ১৪৪ ধারা জারি হয়। তারপরও ছাত্র-জনতা জমা হয় আমতলায়। ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কী হবে না এই নিয়ে শুধু হয় তর্ক। জমায়েত হওয়া ছাত্রদের অনেকেই এর বিরোধিতা করে। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় ভাঙা হবে ১৪৪ ধারা। ১৪৪ ধারা ভেঙে সভা থেকে ১০ জন করে দল গঠন করে মিছিল নিয়ে সেøাগান দিতে দিতে কলাভবনের গেট দিয়ে বের হতে থাকে। দল ধরে মিছিল নিয়ে বের হলেই পুলিশ গণগ্রেফতার চালায়। তার সঙ্গে কাঁদানে গ্যাস। ছাত্রদের দু-তিনটা দল বের হলে সবাইকে পুলিশ ট্রাকে তুলে নেয়। এরপর সিদ্ধান্ত হয় যে মেয়েরা দল ধরে বের হবে। প্রথম দলের কয়েকজনের সঙ্গে থাকে সুফিয়া আহমেদ। ছাত্রীদের দলেও ব্যারিকেড দেয়া হয়। শুরু হয় পুলিশের লাঠির আঘাত। ছাত্রীদের দলের অনেকেও আহত হয়। শুরু হলো ছাত্র-পুলিশের সংঘর্ষ। ইট-পাটকেল দিয়ে ছাত্ররা পুলিশের মোকাবেলা করতে থাকল। এক সময় পুলিশ ছাত্রদের দিকে সরাসরি গুলি চালায়। ঘটনাস্থলে শহীদ হন আবদুল জব্বার ও রফিক উদ্দীন আহমেদ, আহত হন আরও ১৭ জন, তাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ছাত্র আবুল বরকত শহীদ হন রাত ৮টায়।
১৪৪ ধারা ভাঙার পর পরিস্থিতি এমন হবে তা ভাবতে পারেনি কেউ। মেয়েদের ওপর এমন লাঠিচার্জ তাও বুঝতে পারেনি কেউ। সে সময় মেয়েদের সামাজিক অবস্থা ছিল অন্যরকম। ছেলেমেয়েদের মধ্যে কথা বলতে হলেও প্রক্টরের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। সেখান থেকেই স্বাধিকার আন্দোলনের শুরু। মেয়েদের েেত্র ছিল এটি একটি বিপ্লবের মতো। জাতীয় পর্যায়ে ছেলেমেয়েরা এক সঙ্গে কাজ করছে এটাই ছিল অহঙ্কারের। ছাত্রছাত্রী সবার মনে একটাই কথা। বাংলা ভাষার মান রাখতে কাজ করতে হবে। ভাষা আন্দোলনের কথা উঠে এলে আমাদের নারীদের কথা খুব একটা উঠে আসে না। অথচ এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল অনেকে।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনার েেত্র বিকৃতি ঘটছে বলে মনে করেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা। ভাষা আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণের বিষয়টিও যথাযথভাবে উঠে আসেনি। ইতিহাসের এ বিকৃতি সরাতে এবং ঘাটতি পূরণ করতেই বই লেখার কাজে মন দেন রওশন আরা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে মেয়েদের যে দলটি মিছিল নিয়ে বের হয় সেই দলে ছিলেন রওশন আরা বাচ্চু।
১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করা রওশন আরা ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী ছিলেন।
১৪৪ ধারা ভাঙার ফলে পুলিশ যে ব্যারিকেড দেয় সেই ব্যারিকেড ভাঙার কারণে পুলিশের লাঠিসোঁটার আঘাতে তিনিও আহত হন। সে দিন বিকেলে গণপরিষদের অধিবেশন পরিষদ সদস্য আনোয়ারা খাতুন বক্তব্য দিতে গিয়ে যে আহত দু’জন ছাত্রীর নাম বলেন তাদের একজন ছিলেন রওশন আরা বাচ্চু। দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করার পর ২০০২ সালে তিনি অবসরে যান। ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখালেখি করছেন তিনি। বাংলা ভাষা ও ভূখণ্ড নামে একটি বই লেখেন। রওশন আরা বাচ্চু ৩ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
সুফিয়া আহমেদ ও রওশন আরা বাচ্চু তারা মনে করেন ভাষা আন্দোলনের এত বছর পর বাংলা ভাষার যেমন উন্নতি হওয়ার কথা ছিল তেমনটি হয়নি। বিদেশী ভাষার অনুকরণে বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটছে। বাঙালি যে একটি মর্যাদাপূর্ণ জাতি, মূল্যবোধসম্পন্ন জাতি, এ জাতির রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, এ বোধ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিস্তার ঘটেনি। এ কারণে ভাষা সংস্কৃতি তিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা প্রতিরোধের জন্য বাঙালি সংস্কৃতি ও প্রমিথ বাংলা ভাষার চর্চা বাড়াতে হবে। আর স্মরণ রাখতে হবে ভাষার মান রায় নারীরাও এগিয়ে এসেছিল।