চা বাগানে ক্ষতিকারক ‘লুপার ক্যাটারপিলার’ এর আক্রমণ

বৃষ্টি গায়ে মেখে চা গাছগুলো সবুজ হয়ে উঠতে না উঠতেই এখন দেখা দিয়েছে ভিন্ন একটি সমস্যা। 

৫৬৯

দেশের চা বাগানগুলো ইতোমধ্যে কাটিয়ে উঠেছে খরার প্রকোপ। প্রয়োজনীয় বৃষ্টিধারা সতেজ করে দিয়েছে চা গাছেদের কাঙ্ক্ষিত তৃষ্ণা। বৃষ্টি গায়ে মেখে চা গাছগুলো সবুজ হয়ে উঠতে না উঠতেই এখন দেখা দিয়েছে ভিন্ন একটি সমস্যা।

- Advertisement -

এ সমস্যার নাম পত্রখেকো কীটের আক্রমণ। চা গাছের পাতাগুলোকে এরা বিভিন্ন দিক দিয়ে খেয়ে ফেলে। ঘন সবুজ চা গাছগুলো কিছু দিনের মধ্যেই পত্রহীন বৃক্ষে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
এর যথাযথ প্রতিকার না করা হলে পরে ধীরে ধীরে পত্রশূন্য হয়ে গাছটি একসময় তার জীবনীশক্তি হারায়। ঘটে যায় চায়ের সবুজ সম্ভাবনার পরিসমাপ্তি।

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এর পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী বাংলানিউজকে বলেন, সম্প্রতি আমাদের দেশে বেশিরভাগ চা বাগানে ‘লুপার ক্যাটারপিলার’ নামক এক ধরনের কীটের আক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষতিকারক ক্যাটারপিলারের পরিণত দশা হলো মথ (Moth)। পুরুষ ও স্ত্রী মথের মিলন পরবর্তী ডিম থেকেই লুপার ক্যাটারপিলারের জন্ম হয়। এটি ক্যাটারপিলারের ১ম লার্ভাল ধাপ (1st Inster) এবং এ ধাপেই ইহা চা গাছ ও সংশ্লিষ্ট ছায়াতরুর পাতা খাওয়া শুরু করে।
কীটের আক্রমণে পত্রহীন হতে শুরু করেছে চা গাছ। ছবি: বাংলানিউজক্যাটারপিলার মোট পাঁচটি লার্ভাল ধাপ সম্পন্ন করে। পরিণত ক্যাটারপিলার দেখতে পিছনে ও পার্শ্বে সবুজাভ সাদা রেখা সমৃদ্ধ ধূসর বাদামি বর্ণের এবং বাদামি মাথা বিশিষ্ট। চলাফেরার জন্য এদের অগ্রভাগে তিন জোড়া পা এবং পিছনের অংশ দৃঢ়ভাবে ধরার জন্য এক জোড়া ক্লাসপার রয়েছে। সারা বছরে ৪-৫টি জেনারেশন (জীবনচক্র) সম্পন্ন হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।

চা গাছের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে এই পরিচালক বলেন, ক্যাটারপিলার চা গাছের কচি পাতার কিনারা ছিদ্র করে এবং পরে কিনারা বরাবর খেতে থাকে। মধ্যশিরা বাদে সম্পূর্ণ পাতাই খেয়ে ফেলে। পাতা খাওয়া ও ক্যাটারপিলারের বৃদ্ধি সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায় অর্থাৎ এটি আকারে যত বড় হতে থাকে পাতা খাওয়ার পরিমাণও তত বাড়তে থাকে। পূর্ণ বয়স্ক ক্যাটারপিলার পরিণত পাতা খেতে শুরু করে এবং আক্রমণ ব্যাপক হলে এক সময় পুরো গাছটি পাতাবিহীন হয়ে পড়ে।

চা গাছে এর আবির্ভাবের বিষয়ে এই চা বিশেষজ্ঞ বলেন, লুপার ক্যাটারপিলারের আক্রমণ সাধারণত প্রুনিং পরবর্তী বর্ষার পূর্বে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিল মাসে শুরু হয় এবং বর্ষার শেষে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে পুনরায় দেখা যায়। পূর্ণাঙ্গ মথ এসময়ে চা আবাদীতে বিচরণ করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে ছায়াতরু বাকলের গর্তে গুচ্ছাকারে ডিম পাড়ে।

চা গাছের অমসৃণ কান্ড অথবা নিকটবর্তী বাঁশঝাড়ও ডিম পাড়ার উপযুক্ত স্থান। প্রতিটি গুচ্ছে দুশ’ থেকে ছয়শ’টি ডিম থাকে। ক্যাটারপিলার চা গাছের যেকোনো স্থানে অবস্থান করে পাতা খাওয়া শুরু করে। অন্ধকার স্থান হিসেবে চা গাছের দুই কান্ডের মধ্যবর্তী অংশে অথবা গাছের গোড়ার মাটির মধ্যে থাকতে এরা পছন্দ করে বলে জানান ড. আলী।
সবুজ চা গাছগুলো পত্রহীন বৃক্ষে রূপান্তরিত। ছবি : বাংলানিউজ 
ক্ষতিকর ‘লুপার ক্যাটারপিলার’ এর দমন কৌশল সম্পর্কে ড. মোহম্মদ আলী বলেন, পরিচর্যাগত পদ্ধতি, জৈবিক দমন পদ্ধতি এবং রাসায়নিক দমন পদ্ধতি এই ৩ পদ্ধতি এই কীটকে ধ্বংস করার জন্য আমরা চা বাগানগুলোকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছি। নার্সারি অথবা পরিণত/অপরিণত আবাদীতে ক্যাটারপিলার আক্রমণের শুরুতে অথবা আক্রমণের মাত্রা কম হলে হাত বাছাইয়ের মাধ্যমে তা সংগ্রহ এবং মেরে ফেলা যায়। প্রুনিংকালীন সেকশন ফর্কিং এর মাধ্যমে সেখানে লুকিয়ে থাকা পিউপা (কোকুন) ধ্বংস করা সম্ভব। হলুদ ফাঁদ ব্যবহার করে পূর্ণাঙ্গ ক্যাটারপিলারের মথ দমন করা যায়। এ কীটের রোধে চা আবাদীতে বগামেডুলা, কড়ই, শিরিষ, ডেরিস, জারুল, অড়হর ও কাঠবাদাম জাতীয় উদ্ভিদে বিশেষ নজর দিতে হবে।

এই কীট ধ্বংসে জৈব ব্যবস্থাপনা হিসেবে কিছু প্রিডেটর, প্যারাসিটয়েট এবং প্যাথোজেনসমূহ বেশ কার্যকরী। লার্ভাল প্যারাসিটয়েট হিসেবে ব্রিকন হ্যাবিটর একটি গুরুত্বপূর্ণ বায়ো কন্ট্রোল এজেন্ট। যার সঠিক প্রয়োগ সন্তোষজনক দমন নিশ্চিত করে। এছাড়াও মাইক্রোবিয়াল এন্টোমোপ্যাথোজেন এর মাধ্যমে এই কীটের ‘জৈবিক দমন’ সম্ভব। আর ‘রাসায়নিক দমন’ হিসেবে রাসায়নিক স্প্রে অপরিণত কীট দমনে যেমন কার্যকরী, পরিণত কীটে তেমন কার্যকরী নয়। তাই অপরিণত অবস্থায় অর্থাৎ আক্রমণের শুরুতে যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে বলে জানান বিটিআরআই এর পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী।

এই বিভাগের আরও সংবাদ