১৯৬৪ সালে ৩৪ বছর বয়সী জুন আলমেইডা যখন নতুন ধরনের ভাইরাসের খোঁজ পাওয়ার দাবি করলেন তখন একটি পিয়ার-রিভিউ জার্নালে তা প্রত্যাখ্যান করা হলো। তাঁর ধারণ করা ছবিগুলোতে ভাইরাসের চারপাশে যে বর্ণ বলয় বা মুকুটের মতো দেখা গেল তাকে বিচারকেরা ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বাজে ছবি বলে বাতিল করে দিলেন। তাঁরা কি তখন বুঝতে পেরেছিলেন মাত্র পাঁচ দশক বাদেই ওই বাতিল হওয়া বাজে ছবির ভাইরাস বিশ্বজুড়ে মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে?
স্কটিশ ভাইরোলজিস্ট আলমেইডাকেই করোনাভাইরাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেওয়া হয়। বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারি সৃষ্টিকারী সার্স-কোভ-২ ভাইরাস ওই করোনাভাইরাস পরিবারের সদস্য। কোভিড-১৯ সংক্রমণের তীব্রতার সঙ্গে করোনাভাইরাসকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে তাতে আলমেইডা আবিষ্কারটি আবারও আলোচনায় ফিরে এসেছে।
কোভিড-১৯ একটি নতুন ধরনের ভাইরাস, তবে সেটি করোনাভাইরাসের একটি প্রজাতি। ১৯৬৪ সালে লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালের গবেষণাগারে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত করেছিলেন ড. আলমেইডা। তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের এক বাসচালকের মেয়ে। ১৯৬৪ সালে লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতালের গবেষণাগারে প্রথম এই মারণ ভাইরাসের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন।
১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন জুন আলমেইডা। গ্লাসগোর আলেজান্দ্রা পার্কের কাছাকাছি টেনমেন্ট এলাকায় বড় হন তিনি। ১৬ বছর বয়সেই ছেড়েছিলেন স্কুল। আনুষ্ঠানিক বিদ্যার ক্ষেত্রে তিনি সামান্য পড়াশোনা করেই স্কুল ছাড়েন। তবে গ্লাসগো রয়্যাল ইনফার্মারিতে হিস্টোপ্যাথলজিতে গবেষণাগার কর্মী হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন। তারপর পাড়ি দেন লন্ডনে। ১৯৫৪ সালে তিনি এনরিক আলমেইডাকে বিয়ে করেন, যিনি ছিলেন শিল্পী ও ভেনেজুয়েলার বংশোদ্ভূত। পরে এই দম্পতি ও তাঁদের মেয়ে কানাডার টরন্টোতে পাড়ি দেন। সেখানে অন্টারিও ক্যানসার ইনস্টিটিউটে জুন আলমেইডা একটি ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপ নিয়ে তাঁর অসামান্য দক্ষতা দেখান।
২০০৮ সালের আলমেডার এক মরণোত্তর প্রোফাইল অনুসারে, কানাডায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিবিহীন বৈজ্ঞানিক স্বীকৃতি অর্জন করা তখন ব্রিটেনের চেয়ে সহজ ছিল। কোনো আনুষ্ঠানিক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও, তিনি বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধের সহ-লেখক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাসগুলোর গঠন কাঠামোটি বর্ণনা করেছিলেন যা আগে দৃশ্যমান হয়নি।
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসাবিষয়ক লেখক জর্জ উইন্টার বলেন, ড. আলমেইডা এমন একটি পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন যা অ্যান্টিবডি সংহত করার মাধ্যমে ভাইরাসগুলো আরও পরিষ্কারভাবে দেখা সম্ভব হয়। তাঁর এই প্রতিভার বিষয়টি যুক্তরাজ্যের মনোযোগ কাড়ে। ১৯৬৪ সালে তাঁকে লন্ডনের সেন্ট থমাস হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে কাজ করার জন্য প্রলুব্ধ করে যুক্তরাজ্যে ফিরিয়ে আনা হয়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর এই হাসপাতালেই প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল। ফিরে আসার পর তিনি ডক্টর ডেভিড টাইরেলের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন।
উইন্টার বলছেন, ড. টাইরেল স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে অনুনাসিক ধোয়ার ওপর গবেষণা করছিলেন। তাঁরা বেশ কয়েকটি সাধারণ সর্দি-কাশির ভাইরাস বৃদ্ধি দেখতে পারছিলেন, কিন্তু সবগুলো নয়। তার মধ্যে একটি বিশেষভাবে নজরে আসে। সেটির নাম দেওয়া হয়েছিল বি-৮১৪, যা এসেছিল ১৯৬০ সালে সারের একটি বোর্ডিং স্কুলের এক ছাত্রের কাজ থেকে। তাঁরা দেখেন, সাধারণ সর্দি-কাশির কয়েকটি লক্ষণ স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে তৈরি করতে পারলেও, সেগুলো তাদের নিয়মিত কোষের ভেতরে আর বেড়ে উঠতে পারে না। তবে স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে প্রত্যঙ্গের মধ্যে কিছু বৃদ্ধি দেখিয়েছিল। সেটা দেখে অবাক হয়ে ড. টাইরেল ভাবলেন, এটা কোনো বৈদ্যুতিক মাইক্রোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখা উচিত।
তাঁরা সেসব নমুনা জুন আলমেইডাকে পাঠান, যিনি নমুনার মধ্যে ভাইরাস কণা দেখতে পান। সেগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, এগুলো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মতো দেখতে হলেও পুরোপুরি তা নয়। তিনি যা শনাক্ত করেছিলেন, সেটি বিশ্বে করোনাভাইরাস হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
মি. উইন্টার বলছেন, আলমেইডা ইঁদুরের মধ্যে হেপাটাইটিস এবং মুরগির সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস নিয়ে গবেষণা করার সময় এর আগে এ ধরনের কণাগুলো দেখেছিলেন। তা সত্ত্বেও, পিয়ার-রিভিউ জার্নালে পাঠানো তার নথিটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। কারণ রেফারিরা বলেছিলেন, তিনি যেসব ছবি দিয়েছেন, সেগুলো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস কণার বাজে ধরনের চিত্র।’
বি-৮১৪ আবিষ্কারের বিষয়ে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি করোনাভাইরাসের প্রথম যে চিত্র দেখেছিলেন, সেটি প্রকাশিত হয় দুই বছর পরে জেনারেল ভাইরোলজি জার্নালে।
আলমেইডা পরবর্তীতে লন্ডনের পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল স্কুলে কাজ করেন, যেখানে তিনি ডক্টরেট সম্মানে ভূষিত হন। ওয়েলকাম ইনস্টিটিউটে তিনি তাঁর পেশাজীবন শেষ করেন যেখানে বেশ ভাইরাস ইমেজিংয়ের ক্ষেত্রে তাঁর নামে বেশ কয়েকটি স্বত্বাধিকার হয়। ওয়েলকাম ছেড়ে দেওয়ার পর ড. আলমেইডা যোগ ব্যায়ামের প্রশিক্ষক হন। তবে পরবর্তীতে ১৯৮০-এর দশকে তিনি এইচআইভি ভাইরাসের ইমেজিং-এর ক্ষেত্রে একজন পরামর্শক হিসেবে কাজ করেন।
২০০৭ সালে, ৭৭ বছর বয়সে জুন আলমেইডা মারা যান। মৃত্যুর তেরো বছর পরে তিনি তাঁর সেই কাজের জন্য অবশেষে স্বীকৃতি পাচ্ছেন, যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসটি সম্পর্কে বুঝতে সহায়তা করছে।
আলমেইডাকে ইমিউন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের একটি সহজ কৌশল ব্যবহারের প্রাথমিক পথিকৃৎ হিসেবে স্মরণ করা হয়, যা বিজ্ঞানীদের পক্ষে ভাইরাসগুলো দেখা সম্ভব করেছিল। মার্কিন সরকারের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বিশেষজ্ঞ এ জেড কাপিকিয়ানকে ইমিউন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের কৌশল শেখানোর কৃতিত্ব দেওয়া হলো আলমেইডাকে। কাপিকিয়ান এ কৌশলেই ‘নরোভাইরাস’ শনাক্ত করেন যা ‘শীতকালে বমির প্রাদুর্ভাব ঘটায়’।