চলমান করোনা প্রভাবে বনের ভেতরে পর্যটকের যাতায়াত কমে যাওয়ায় খাদ্যাভাবে চরম দুর্ভোগে পড়ে খাদ্যের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসছে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী।
অন্য সময়েও বনের প্রাণীরা লোকালয়ে আসতো তবে এ সময়ে তাদের আসাটা একটু বেশি। এককথায় করোনার এ সময়ে করুণ পরিণতিতে পড়েছে মধুপুরের বন্য প্রাণীরা।
ভ্রমণ এলাকায় বানর হনুমানের উপযোগী ওই খাবার পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে এ সময় ভাসমান দোকানিরাও আয় রোজগার করতেন। স্থানীয় ভাসমান দোকানিদের ওই আয় রোজগারে সংসার চলে। এবার প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়ে প্রশাসন থেকে এ বনে পর্যটক আসা-যাওয়ার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এতে করে মধুপুর বনের জাতীয় উদ্যান, দোখলা পিকনিক স্পট, লহুরিয়া হরিণ প্রজনন কেন্দ্র তথা চিড়িয়াখানাসহ দর্শনীয় স্থানগুলো একেবারে জন মানবশূন্য।
তাছাড়া বনের পশুদের জন্য সরবরাহ করা সরকারি খাবারও প্রয়োজনের তুলনায় কম। এতে বনের পশু-পাখি তথা বানর-হনুমানগুলো চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
মধুপুর বনাঞ্চলের দোখলা, জাতীয় সদর উদ্যান, চাড়ালজানী ও রসুলপুর রেঞ্জের আওতায় বানর-হনুমানের খাদ্য উপযোগী শাল-গজারী, কাইকা, সাইদা, আজুলী, জয়না, ভুতুম, কুম্বি, জিগা, সোনালু ও সেন্দুরীসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ উজাড় হওয়ার কারণেও বানর-হনুমানের প্রাকৃতিক খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। খাদ্যের সন্ধানে বানর হনুমানসহ পশু-পাখি ছুটাছুটি করছে।
এদিকে আয় রোজগার বন্ধ থাকায় বেকায়দায় পড়েছেন বনের মধ্যে পর্যটকদের কাছে বানর হনুমানের খাবারসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করা ভ্রাম্যমাণ দোকান মালিকরাও।
দোখলার দোকানদার রফিকুল ইসলাম রফিক, মালেক, বাবুল গৌড়সহ অনেকে জানান, হঠাৎই এমন পরিস্থিতিতে পড়ে তাদের ব্যবসা ও আয় রোজগার বন্ধ। মালামাল আটকা পড়ে লোকসানে আছেন তারা।
সন্তোষপুর রাবার বাগানের কর্মচারী ও স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি গণমাধ্যমকে জানান, বানর-হনুমান দেখার জন্য এ বনে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক দর্শক আসতেন। তারা বানর-হনুমানগুলোকে কলা, কেক, বিস্কুট, পাউরুটি দিয়ে আনন্দ উপভোগ করতেন। কিন্তু করোনার কারণে লোকজন আসা-যাওয়া বন্ধ থাকায় বন্যপ্রাণীরা বাড়তি খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বন এলাকার স্থানীয়রা আরও জানান, খাদ্যাভাবে বন থেকে প্রতিদিন দল বেঁধে বানর-হনুমানগুলো বেরিয়ে এসে আশপাশের আনারস, কলা ও সবজি বাগান তছনছ এবং বিভিন্ন ফল-ফলাদি সাবাড় করে ফেলে। আর এসব ফল-ফলাদি ও ফসল রক্ষার্থে অনেকেই বিষটোপ ব্যবহার করে থাকে। এতে অনেক বানর-হনুমান মারা যায়। বনের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়ক পারি দেওয়ার সময় দ্রুতগামী যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।
মধুপুর পৌর এলাকার বাসিন্দা টিআইবির ইয়েস সদস্য খালিদুজ্জামান মানিক সম্প্রতি সড়ক পারাপার হতে গিয়ে দ্রুতগামী ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে একটি মেছা বিড়াল ও শিয়াল জাতীয় একটি প্রাণির নিথর দেহ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছেন।
তিনি জানান, চালকদের হর্ণ বাজিয়ে বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানো বন্ধ রাখা জরুরি। বনের রাস্তায় যানবাহন চলাচলে চালকদের সতর্ক করার কোনো প্রক্রিয়া করা যা কিনা সংশ্লিষ্টদের প্রতি তিনি সে অনুরোধ জানিয়েছেন।
অধিকাংশ বনাঞ্চল অধ্যুষিত অরণেখোলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুর রহিম জানান, মধুপুর বনাঞ্চলের বানর-হনুমান ও হরিণের জন্য সরকার প্রতিমাসে যে টাকা বরাদ্দ দিয়ে থাকে তার কিছুটা হরিণ প্রজনন কেন্দ্রে হয়ত ব্যবহার হয়। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম। আর বাকি বরাদ্দ বানর-হনুমানের জন ব্যয় করা হয় না। এ জন্যই অভুক্ত অবুঝ প্রাণীগুলো খাবারের সন্ধানে বন ছেড়ে লোকালয়ে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে।
মধুপুর বনের লহুরিয়া বিটের বিট কর্মকর্তা আ. জলিল জানান, টাঙ্গাইল বন বিভাগের আওতায় জাতীয় সদর উদ্যান, দোখলা ও চাড়ালজানী রেঞ্জে প্রায় ১০ হাজার বানর-হনুমান রয়েছে। এদের সরকারিভাবে টোকেন খাবার হিসেবে কলা, বাদাম ও বিস্কুট দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় চাহিদামত খাবার দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া করোনার কারণে পর্যটক আসা বন্ধ হওয়ায় বাড়তি খাবারও পাচ্ছে না।
মধুপুর বনাঞ্চালের বন্যপ্রাণীর খাবার সরবরাহকারী ঠিকাদার টাঙ্গাইলের বাসিন্দা উত্তম কুমার জানান, এ বনের বানর-হনুমানের খাবার সরবরাহের জন্য প্রতিমাসে মাত্র ৯ হাজার ৬৮৫ টাকা এবং লহুরিয়া হরিণ প্রজনন কেন্দ্রের জন্য ৩২ হাজার ৯৪০ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়।
বনের বানর হনুমানসহ প্রাণিদের বরাদ্দ অনুযায়ী নিয়মিত খাবার দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন মধুপুর বনের সহকারী বন সংরক্ষক জামাল হোসেন।